সূর্যাস্ত আইন কী ? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রত্ন কাকে বলা হতো এবং কেন ? অবশিল্পায়ন কী ?বাগিচা শিল্প কী ?
চাকরির পরীক্ষা এবং ইতিহাস পরীক্ষার উপযোগী কিছু প্রশ্ন উত্তর
● সূর্যাস্ত আইন কী ?
উঃ। জমিদারদের কাছে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রাথমিকভাবে জমির মালিকানা জমিদারদের হাতে থাকলেও জমির প্রকৃত মালিকানা ছিল কোম্পানির হাতে। নির্দিষ্ট একটা তারিখের মধ্যে সূর্য ডোবার আগেই প্রাপ্য খাজনা কোম্পানিকে জমা দিতে হতো। না পারলে জমিদারি অন্যত্র বিক্রি করার অধিকার কোম্পানির ছিল। এই ব্যবস্থা সূর্যাস্ত আইন নামে পরিচিত ছিল।
● ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রত্ন কাকে বলা হতো এবং কেন ?
উঃ। আঠারো শতকের শেষ দিকে থেকে পরবর্তী দেড় শতকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ প্রশাসন ভারতের অর্থনীতিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থে পরিচালিত করতে উদ্যোগী হয়েছিল। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের পরে বলা হয় ব্রিটিশ শাসনের যাবতীয় ব্যয়ভার ভারত থেকে বহন করতে হবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে যথেচ্ছভাবে ভারতীয় সম্পদ ব্যবহার করা যাবে। ভারতের বাজার ব্রিটিশ পণ্যের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের ল্যাঙ্কাশায়ারে তৈরি সুতির কাপড়ের ৮৫ শতাংশ ভারতে বিক্রি হতো।ভারতীয় রেলের ব্যবহৃত লোহা ও ইস্পাতের ১৭ শতাংশ আসত ব্রিটেন থেকে। ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যের অভিমুখব্রিটেনের স্বার্থেই পরিচালিত হতো। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ভারতকেই সবচেয়ে দামি রত্ন হিসাবে বর্ণনা করা হতো।
● চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র কী সমালোচনা করেছিলেন ?
উঃ। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর ভাষায় “জীবের শত্রু জীব, মানুষের শত্রু মানুষ, বাঙালী কৃষকের শত্রু বাঙ্গালী ভূস্বামী। জমীদার নামক বড় মানুষ কৃষক নামক ছোটমানুষকে ভক্ষণ করে, কৃষকদের পুরো উদরস্থ করেন না বটে কিন্তু যাহা করেন তাহা অপেক্ষা হৃদয়শোণিত পান করা দয়ার কাজ।" এই “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত" বঙ্গদেশের অধঃপাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মাত্র–কস্মিনকালে ফিরিবে না। ইংরাজদিগের এ কলঙ্ক চিরস্থায়ী।
● অবশিল্পায়ন কী ?
উঃ। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই কোম্পানির হাত থেকে ভারতের বাজারের একচেটিয়া অধিকার চলে যায়। ধীরে ধীরে বিভিন্ন ব্রিটিশ পণ্য ভারতে আমদানি করা হতে থাকে। ভারতীয় শিল্প ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর প্রতিযোগিতা ও বাধার সম্মুখীন হয়। দেশীয় শিল্পগুলি ক্রমশ ধ্বংস হতে থাকে, একে বলে অবশিল্পায়ন। বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মচ্যুত হন। কারিগর ও শিল্পীরা জীবিকার জন্য চাষের কাজে যোগ দেয়। ফলে কৃষি অর্থনীতির উপর তীব্র চাপ পড়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বিদেশি দ্রব্যে ভারতের বাজারগুলি ছেয়ে যায়। বিভিন্ন দেশীয় শিল্পের অবনমন ঘটে। অবশিল্পায়নে সরকার কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি।
● বাংলার প্রজাদের দুরবস্থা সম্পর্কে অক্ষয়কুমার দত্তের সমালোচনা কী ছিল ?
উঃ। “যে রক্ষক সেই ভক্ষক"—এই প্রবাদ বাংলার ভূস্বামীদের ব্যবহারে দেখা যায়। ভূস্বামী নিজের সিংহাসনে বসলে প্রজারা এক দিনের । নিশ্চিত্তে থাকতে পারে না। কখন কী উৎপাত ঘটে এই ভেবে তারা দিনরাত শঙ্কিত থাকত। ভূস্বামীর কি কেবল নিজের রাজস্ব নিয়ে পরিতৃপ্ত হবেন? না ছলে বলে কৌশলে তাদের যথাসর্বস্ব গ্রহণ করবেন? তাদের হতদরিদ্র অবস্থা, জীর্ণ শরীর, মলিন বসন কিছুতেই জমিদারের হৃদয়কে বিগলিত করতে পারে না। তাদের চোখে এক ফোঁটা জলও আনতে পারে না। তিনি ন্যয্য-রাজস্ব ভিন্ন বাটা, আদায়ি রাজস্বের নিয়মাতিরিক্ত বৃদ্ধি, বাটার বৃদ্ধি, বৃদ্ধির বৃদ্ধি, আগমনি, পার্বণি, হিসাবানা প্রভৃতি অশেষ প্রকার উপলক্ষ্য করে ক্রমাগত প্রজা নিপীড়ন করতে থাকেন। এই ছিল বাংলার কৃষকদের সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অক্ষয়কুমার দত্তের সমালোচনা।
● মহাজনি ব্যবস্থা বলতে কী বোঝ ?
উঃ। ঔপনিবেশিক আমলে মহাজনদের সমাজে বিশেষ ভূমিকা দেখা দেয়। চড়া হারে ও নগদ অর্থে রাজস্ব মেটাতে প্রজাদের ঋণগ্রহণ করতে হতো। প্রজারা ছিল নিরক্ষর, এই সুযোগে মহাজনরা কারচুপি ও জালিয়াতি করে সুদ আদায় করে যেত। কোম্পানির আইন ছিল জমিদারদের জন্য ফলে আইনের সাহায্য নিয়ে মিথ্যা মামলা করে প্রজাদের সম্পদ তারা কেড়ে নিত। বিভিন্ন অঞ্চলে যে প্রজা বিদ্রোহ দেখা দিত তার আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল মহাজন ও মহাজনি ব্যবস্থা।
● বাগিচা শিল্প কী ?
উঃ। নীল চাষ ছাড়াও বিভিন্ন বাগিচা শিল্পে ইউরোপীয়দের আগ্রহ ছিল। মূলত তাদের উদ্যোগেই বাগিচা শিল্প গড়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে আসাম, বাংলা, দক্ষিণ ভারত ও হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে চা বাগিচা শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। বিদেশি কোম্পানিগুলিকে করের ছাড় ও নানা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। চা ও কফি রফতানি ক্ষেত্রে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। মালিক বিদেশি হওয়ায় মুনাফার অর্থ বিদেশে চলে যেত। আর বেতনের বেশির ভাগটাই পেত বিদেশি কর্মচারীরা। উৎপন্ন দ্রব্যগুলিও বিদেশের বাজারে বিক্রি করে তার অর্থ ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হতো।
● আসামের চা বাগান ও শ্রমিক অধিকার সম্পর্কে কী জানা যায় ?
উঃ। বাগিচা শিল্পের শ্রমিক হিসাবে স্থানীয় লোকেদের নিয়োগ করা হতো। সামান্য মজুরি ও চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যে শ্রমিকদের কাজ করতে হতো। ব্রাম্মনেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় সর্বপ্রথম শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেন। আসামের চা বাগানগুলি ঘুরে ইউরোপীয় মালিকদের অত্যাচার ও শ্রমিকদের দুর্দশার কথা তিনি “সঞ্জীবনী পত্রিকাতে প্রকাশ করেন। রামকুমার বিদ্যারত্নও ধারাবাহিকভাবে সঞ্জীবনী পত্রিকায় “কুলি-কাহিনী” নিবন্ধ লিখতে থাকেন। দ্বারকানাথ ও রামকুমারের উদ্যোগে দেশের মানুষও ঔপনিবেশিক শাসকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ঔপনিবেশিক ভারতে শ্রমিকদের হয়ে লড়াই করার এটি একটি পুরোনো নজির।
● ঔপনিবেশিক প্রশাসনের তরফে কৃষকদের জন্য কী আইন করা হয় ?
উঃ। দাক্ষিণাত্যে ক্রমাগত কৃষক বিদ্রোহ ঘটতে থাকলে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক সরকার বাধ্য হয়ে Agricul turists Relief Act জারি করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল চাষিদের ঋণের বোঝা কিছুটা কমানো। ধার শোধ না হলে চাষিদের গ্রেফতার বা আটক করা নিষিদ্ধ হয়। তার বদলে গ্রামে বিচার সভা বসিয়ে সাধুকার ও কৃষকদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঋণশোধের ব্যবস্থা করা হয়। একইভাবে বাংলায় জমিদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে Tenancy Act ছিল। আইন মোতাবেক অস্থায়ী রায়তদের দখলিস্বত্ব দেওয়া হয়। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়, আদালতের পরোয়ানা ছাড়া কোনো রায়তকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। খাজনা বাড়ানোর জন্য জমিদারকে নির্দিষ্ট কারণ দর্শাতে হবে।
COMMENTS